Skip to content
Ahmed-Sadhana-Maatbring-Poster-Delhi

সাধনা আহমেদের ‘মাতব্রিং’

আফসার আহমদ

সাধনা আহমেদ কবি, নাট্যকার ও অভিনয়শিল্পী। তাই কবির হাতে নাটক হয়ে ওঠে দৃশ্যের কাব্য। সাধনা আহমেদের মাতব্রিং নাটকে গারো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ক্রমাগত উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার অক্লেশ বর্ণনার ভেতরে তৈরি হওয়া দৃশ্যাবলির ভেতর দিয়ে আমি পৌঁছে যাই বিরিশিরি, সোমেশ্বরী বা কলমাকান্দা গ্রামের গারো জনজীবনে। বঞ্চিত মানুষ, ক্ষয়ে যাওয়া মানুষ, টুকরো হয়ে যাওয়া মানুষ এবং ক্রুর সময়ের আক্রমণে পর্যুদস্ত উদ্দেশ্যহীন মানুষের মুখের রেখায় সময়কে তুলে ধরেছেন বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে। নাটকের ঘটনাগুলো অনিবার্য হয়ে উঠেছে গল্পের গাঁথুনির কারণে। নাটকটির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ব্যক্তিগত প্রেম। ব্যক্তিক প্রেম সামাজিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসনে কীভাবে ক্ষয়ে যায়, তার মর্মস্পর্শী বিবরণের সঙ্গে ভূমিদস্যুদের দখলের ফলে ওই জনপদে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়, তা দেখিয়েছেন নাট্যকার। দূরে থেকে চরিত্র ও ঘটনার অনিবার্যতায় কেবলই খুঁজেছেন জনজীবনের যৌথ অবস্থানের ভেতর দিয়ে ব্যক্তিজীবনের বঞ্চনার ইতিহাস। এমনই করে ব্যক্তি ও সামাজিকগণের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি এক বিন্দুতে মিলিয়ে দিয়েছেন সাধনা আহমেদ।

মাতব্রিং নাটকে গদ্য সংলাপের ভেতরে গভীর কাব্যময়তা এবং এমন একটি ভাষা ও সংলাপ রীতি তৈরি হয়েছে, যা সাধনা আহমেদের একেবারেই নিজের। ফলে বর্ণনা, সংগীত ও সংলাপের যে ত্রয়ী তৈরি হয়েছে, তার অনিবার্যতায় নাটক মঞ্চায়নে নৃত্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। আর এভাবেই নাটকটি বর্ণনাত্মক বাংলা নাটকের সামীপ্যে পৌঁছে যায়।

 নাট্যকারের চিন্তার অস্বচ্ছতা নেই বলে ক্রমাগত ভূমিদস্যুদের দখলে গারো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বাস্তবতার দ্বান্দ্বিক সংঘাত নাটকে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তাতে বিপর্যস্ত হয়েছে পৃথিবীর সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনজীবন। মাতব্রিং নাটকে এই বিষয়টি পাঠের অন্তর্পাঠ হিসেবে রূপায়িত বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। বহু সংস্কৃতির দেশ বাংলাদেশ ক্রমেই অন্য আরেকটি সংস্কৃতির সর্বনাশা টানে কোন অতলে তলিয়ে যাচ্ছে, নাটকে এই বেদনার প্রকাশে নাট্যকারের সর্বজনীন জীবনবোধের প্রবল প্রকাশ দেখা যায়।

ধর্ম, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক বিপরীতমুখী টানে এই নাটক তরতর করে এগিয়ে চলে পরিণতির দিকে। নাট্য ঘটনার এই পরিণাম সংঘটনে নাট্যকার নন, যেন অদৃশ্য ঈশ্বর অলক্ষ্যে সক্রিয় থেকেছেন। ফলে সাধনা আহমেদের আধুনিকতা স্পষ্টতই জনপদ ও সময় চেতনাকে ধারণ করে পরিবাহিত হয়েছে। সেই বিবেচনায় সাধনা আহমেদ বাংলা নাটকের ঐতিহ্যকে ধারণ করে একজন আধুনিক নাট্যকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। একটি সাধারণ গল্পের ভেতরে একটি জনজীবনের অসাধারণ বিনির্মাণ একজন শক্তিশালী নাট্যকারের পক্ষেই সম্ভব।

৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬, যশোরে মাতব্রিং নাটকটি দেখতে গিয়ে মঞ্চের আলো-অন্ধকারে আমি চমকিত ও বিস্মিত হই গারোদের সৃষ্টিদেবতা তাতারারাবুগার মানবিক বিন্যাসে। শূন্য মঞ্চে এক অপার্থিব দৃশ্যের উন্মোচন আমাকে মুহূর্তে গারো মিথের ভুবনস্পর্শী করে। অতঃপর তাতারারাবুগারূপী অভিনেতা বাংলা নাটকের গায়েন হয়ে ওঠেন। আধুনিক মঞ্চনাটক যে নির্দেশকের শিল্প, তা ইফসুফ হাসান অর্ক আবার প্রত্যক্ষ করালেন। বাংলা নাটকের মূল প্রবণতা সংগীতকে আশ্রয় করে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের চলনকে তুলে এনেছেন তাঁর নির্দেশনাশৈলীতে। ফলে পুরো নাটকে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর জীবনের ভেতর দিয়ে সর্বকালের মানুষের বেঁচে থাকার শক্তির উৎস খোঁজার দিকেই ক্রমেই এগিয়ে গেছেন নির্দেশক।

বর্ণনার পাশাপাশি নানা দৃশ্যের বিনির্মাণ নাটকটির মঞ্চায়নে বহুমাত্রিকতা এনে দিয়েছে। ইউসুফ তাঁর নির্দেশনাশৈলীতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ভেদরেখা ঘুচিয়ে নাট্যমুহূর্ত নির্মাণের দিকেই ঝুঁকেছেন। প্রজেক্টরে যুদ্ধ কিংবা মানুষের ছিন্নমূল হয়ে ওঠার চিত্র প্রদর্শন করে এ দেশীয় গল্পের সাযুজ্যে একটি বিশ্বমুখিন মাত্রা সংযুক্ত করেছেন। এখানে নির্দেশক শিকড়কে ধারণ করে বিশ্বনাট্য নন্দন-ভাবনায় জারিত হয়েছেন।

নাটকের সংগীত পরিকল্পনা করেছেন নির্দেশক ইউসুফ হাসান স্বয়ং। গান শুনতে শুনতে দর্শক টেক্সটের অতীত সাবটেক্সটের অন্তর্গত ভূমিতে বিচরণ করে। নির্দেশক সংগীত পরিকল্পনায় বুঝিয়েছেন যে নাটকের সংগীত, সংলাপ ও বর্ণনা অবিভাজ্য ও দ্বৈত-অদ্বৈতের লীলায় মুখর।

নাটকের পোশাক পরিকল্পনা করেছেন আইরিন পারভীন লোপা। গারো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার পোশাকের হুবহু অনুকরণ নেই বলেই পোশাক পরিকল্পনায় একটি সর্বজনীন আবহ তৈরি হয়েছে। নাটকটির পোশাক পরিকল্পনার কারণেই সমগ্র নাটকে আলংকারিক সৌন্দর্যের ব্যাপ্তি ঘটেছে।

আলোক পরিকল্পনা করেছেন শাহীন রহমান। আলোক পরিকল্পনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই নাটকের নাট্যদৃশ্য কখনো দর্শকের চোখের আড়ালে চলে যায়নি।

তাতারারাবুগার ভূমিকায় সানোয়ার আলম খান দুলুর অভিনয় মন কাড়ে। তাতারারাবুগার অদেখা ব্যক্তিত্ব কিংবা ঐশ্বরিক প্রতিভাস দুলুর চলনে ও বলনে ফুটে উঠেছে। দুলু তাঁর অভিনয়ে দর্শকের অংশীদারির কথাটি বিবেচনায় রেখেছেন বলেই নাট্য চরিত্রকে বিকাশমান রাখতে পেরেছেন। মিত্তি ও কানু চরিত্রে জাহিদুল ইসলাম যাদু ও তানজিলা জিনি যথার্থ অভিনয় করেছেন। যাদুর শারীরিক অভিনয়, দর্শক মনে রাখবে অনেক দিন। কলাবতী সাংমার চরিত্রে অদিতি সরকার রুমার অভিনয় অনবদ্য। মিত্তির মা রুগালা মারাকের চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছেন কাকলী। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিউটি, কমল, জাহিদ, মানস, রিপন, তুলি, এলিস, সাথীসহ আরও অনেকে।

কোরিওগ্রাফি করেছেন অদিতি সরকার রুমা। পরিচ্ছন্ন ও দৃষ্টিনন্দন কোরিওগ্রাফি মুগ্ধতা আনে। গারো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বাদ্যযন্ত্র দামা বাজিয়ে নৃত্যের চলন নাটকটির মঞ্চসৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। যশোরের বিবর্তন নাট্যদলের মাতব্রিং নাটকটি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ প্রযোজনার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে বলে আমি দৃঢ় আশাবাদী।

আফসার আহমদ, অধ্যাপক, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

[প্রথম আলো পত্রিকায় ১৯ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত। মূল লেখা পড়তে লিংক অনুসরণ করুন।]